Wednesday, August 31, 2011

ছোটগল্পঃ দাদী এবং একটি জাদুর গল্প

দাদী এবং একটি জাদুর গল্প
- সালেহ মাহমুদ
দাদীর তখন গল্প বলার বেজায় ঝোঁক। মাগরিব নামাজের পর অনেকক্ষন বসে বসে তসবিহ জপলেন। তারপর আরো কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে এসে যোগ দিলেন উঠানে বিছানো পাটিতে বসা নাতি-নাতনিদের আসরে। আকাশ পরিষ্কার। জৈষ্ঠ্যের এই সময়টাতে যে কোন সময় উত্তর আকাশ কালো করে ঝড়-বৃষ্টি ধেয়ে আসতে পারে। কিন্তু আজকে সেই রকম কোন লক্ষণ নেই। বাতাসও আছে মন্দ না। আম-কাঁঠালের এই সময়টাতে ঢাকা থেকে তার সমস্ত নাতি-নাতনিরা গ্রামের বাড়ীতে চলে আসে সপ্তাহ দুই থাকার জন্য। তখন এই বাড়ীটা গম গম করে। আর দাদীর ব্যস্ততা বেড়ে গেলেও কাজ যায় কমে। বড় বউ, মেঝো বউ আর বছুইরা কাজের মেয়েটা ছাড়াও গ্রামের আরো চার-পাঁচজন মেয়ে মানুষ সর্বক্ষণ রান্না-বান্না এটা-সেটা করে দেয়। নাতি-নাতনিরা যতদিন থাকবে ততদিন এ রকমই চলতে থাকবে। সবাই যেদিন চলে যাবে সেদিন আবার যেই কে সেই। বাড়ীটা শুনশান হয়ে যায়। বছুইরা কাজের মেয়েটা আর সে ছাড়া কেউ থাকে না বাড়ীতে। সারাদিন প্রায় একা একাই থাকতে হয় দাদীকে।
দাদী গল্প জুড়ে দেয়- হোন, তরা তো একেকজন স্কুল-কলেজে পইড়া খুব লেহাপড়া হিগছছ। তগ মাস্টর আছে, কোচিং আছে, আরো কত কি! আর আমি কেমনে পড়া হিগছি জানছ? জানছ না, জানবি কেমনে? কোনদিন তো তগ কই নাই। এইবার তইলে হেই কতাই কই।
আমার বয়স যহন তের তহন আমার বিয়া অয় তগ দাদার লগে।
হায় আল্লা, কও কি তুমি দাদী, এত ছোডকালে তোমার বিয়া অইছিল, তোমার শরম করে নাই? বড় নাতনি রিনা আশ্চর্য হয়ে মাথায় দুই হাত তুলে জিজ্ঞাসা করে।
আরে ধুর ছেমড়ি, তহন তো বিরটিশ আমল। হেই সময় দশ বছর অইলেই মাইয়াগো বিয়া দিয়া দিতো। আমি তো একটু বড় অইলে পরে আমার বিয়া অয়।
আইচ্ছা দাদী, আমগ দাদার বয়স তহন কত আছিলো? আর এক নাতি প্রশ্ন করে বসে।
তর দাদার বয়স তহন কত আর, এই ধর গিয়া পুনরো-ষুলো অইব আর কি। আমার বাপে আছিল আবার মৌলভী মানুষ। তর দাদায় আছিল পুলাপান, কিন্তু নামাজী, হেইল্যেগাই তগ দাদারে আমার বাপে পছন্দ করছিল। তগ দাদায় লেহাপড়া হিগছিল, কিন্তু পাশ দেয় নাই। বই-কিতাব সব পড়তে পারে, লেখতে পারে। হিসাব-কিতাবও করতে পারে তগ দাদায়। শেষে তো তগ দাদায় মুন্সিই অইয়া গেল।
মুন্সি অইল কেমনে? কোন একজন প্রশ্ন করে বসে।
আরে আগের দিনে যারা আরবী ভালো কইরা পড়তে জানতো, আরবী লেখতে পারতো, তাবিজ-কবজ লিখতে পারতো হেগ মুন্সি কইতো। অইছে কি, তর দাদার আতের লেহা আছিল অনেক সুন্দর। যেমুন বাংলা লেখত, হেমুন আরবী। এইল্যেগা মসজিদের ইমাম সাব তগ দাদারে দিয়া তাবিজ-কবজ লেহাইত, দোয়া-দরুদ লেহাইত। এমনে করতে করতে কোন সময় যে হেয় নিজেই ওস্তাদ অইয়া গেছে হেয় নিজেও জানত না। যহন এদিকতে হেদিকতে মাইনষে তাবিজ-কবজ লেহানের লইগা তগ দাদার কাছে আওন শুরু করলো তহন তগ দাদার নাম হইয়া গেল মুন্সি। দেহছ না অহনও দশ গেরামের মানুষ এই বাড়ীরে চিনে মুন্সিবাড়ী নামে।
হ দাদী বুঝলাম দাদার মুন্সী হওনের কথা, কিন্তু আপনে পড়ালেহা হিগলেন কেমনে? কেউ একজন জিজ্ঞেস করে।
হ হ হেই কতাই তো কইতাছি। আমি কিন্তু পড়তে জানি খালি, লেখতে জানি না, হেইডা কি তরা জানছ?
এ্যা, এইডা তো জানি না। সকল নাতি-নাতনিরা সমস্বরে বলে ওঠে আশ্চর্য হয়ে।
আরে হ, ঠিকই কইতাছি। হোন তাইলে, আমার বিয়ার পর যহন এই বাইত আইয়া উডি, তহন তর দাদারা চাচাত ভাইরা মিইল্যা গরু লইয়া এই পূবের চালায় ছাইড়া দিত। তহন এই বাইততে ধইরা হেই ধলি বিল পর্যন্ত আছিল খোলা মাঠ। গরু ছাইরা দিলে ঘাস খাইয়া পেট ফুলাইয়া ফালাইত। খালি জঙ্গলের ভিতরে গেলেই ডর। হেইডাই খেয়াল রাখত তর দাদারা। হেরা করত কি এই রদ্দার (দেয়াল) আউলে (আড়ালে) বইয়া জোরে জোরে চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া স্কুলের পড়া পড়ত। আদর্শ লিপি বইয়েততে হেরা সুর কইরা অ আ ই ঈ পড়তো। পড়তে পড়তে কতক্ষন পরপরই বই থুইয়া দৌড়াইয়া যাইত গা খেলতে। আর আমি করতাম কি, তহন দৌড়াইয়া গিয়া হেগ বই উলডাইতাম আর আন্দাজ কইরা কইরা অ আ ই ঈ পড়তাম। হেগ পরা হুইন্যা হুইন্যাই আমার পরা মুহস্ত অইত, হেরা গেলেগা আমি মুহস্ত পড়া বইয়ের লগে মিলাইয়া লইতাম। এমনে এমনে কইরাই আমি পরতে হিগছি, বুঝছত।
এইবার থামে দাদী। দাদীর গল্প শুনে নাতি-নাতনিরা সবাই উত্তেজনায় টানটান হয়ে বসে পড়ে। অবাক হয় দাদীর মেধার পরিচয় পেয়ে। তাদের আফসোস হয়, ইশ যদি দাদীরে ইস্কুলে ভর্তি করাইয়া দেওন যাইত, তইলে নির্ঘাৎ এম.এ. পাশ কইরা ফালাইত। একজন তো বলেই ফেলে, ইশ দাদী গো কেইল্লেগা যে তোমারে স্কুলে ভর্তি করাইল না! যদি করাইত, তইলে তুমি নিশ্চয়ই এম.এ. পাশ কইরা ফালাইতা, কি ঠিক কইছি না দাদী?
শুনে দাদী লজ্জা পায়। এই বুড়ো বয়সেও তার গাল লাল হয়ে যায়। যদিও অন্ধকারে কেউ তা খেয়াল করে না। দাদী বলে ওঠে, আমি এম.এ. পাশ করি নাই তো কি অইছে, তগ বাপ-চাচা তিনোডারেই তো এম.এ. পাশ করাইছি। কি করছে না? তাও এহেকজনে ফাস্ট সেকেন্ড অইছে পরীক্ষায়। পরীক্ষায় ভালা রেজাল্টের লইগা আমার বড় পুতেরে সারা দেশের মাইনষে এক নামে চিনে।
বড় নাতনি রিনা’র মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে যায়। সে জিজ্ঞেস করে, ও দাদী তোমার বড় পুতের নাম কি?
দাদী অত কিছু চিন্তা করে না, বলে- কে ইউসুফ।
বড় নাতনি এবার গলায় সুর তুলে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কি গো দাদী?
দাদী এতক্ষণে বুঝতে পারে বড় নাতনির দুষ্টুমি। হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ওরে শয়তান তুই আছছ শয়তানী লইয়া।
এই বলেই বড় নাতনি রিনা’র চুলের মুঠি ধরে পিঠের মধ্যে দুম করে একটি কিল বসিয়ে দেয়। রিনা কিল খেয়ে যেন আরো উৎসাহী হয়ে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, কে তুমি কইতে পারো না তোমার নাম।
ধুর ছেমড়ি, শরমের কতা আবারও কয়।
ছোট নাতি-নাতনিরা এবার বেড়িয়ে ধরে দাদীকে, ও দাদী কওনা তোমার নাম। আমরা তো জানি না।
দাদীর মুখে এবার রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে, ক্যা, তরা কি কোরান শরীফের ইউসুফ-জুলেখার কাহিনী পড়ছ নাই।
স্কুল পড়ূয়া এক নাতি এবার বলে ওঠে, ও বুচ্ছি তোমার নাম তইলে জুলেখা। ইউসুফ নবীর প্রেমে পরছিল জুলেখা বিবি। এইডা আর এমুন শরমের কি? কাহিনী যেমুনই হোক, তোমার নাম জুলেখা আর তোমার পোলার নাম কি ইউছুফ অইতে পারে না?
এই কথা শুনে সবাই এবার হো হো করে হেসে ওঠে।
বাড়ীর উত্তরের গজারী বন থেকে কেক্কা হুয়া কেক্কা হুয়া করে সমস্বরে অনেকগুলো শেয়াল চিৎকার করে ওঠে। আর বাড়ীর অঘোষিত পাহারাদার তিনচারটা কুকুর ঘেউ ঘেউ, ঘেউউউ... করে তার জবাব দিতে থাকে। উঠানে গল্পের আসরের সকল নাতি-নাতনি একদম চুপ মেরে যায়। দাদীও কেমন মৃয়মান হয়ে ওঠেন। দুইতিনজন নাতিনাতনি দাদীকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, ও দাদী চুপ মাইরা গেলা কেন? তোমার কি মন খারাপ অইছে?
দাদী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। তার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে যেন অনেক দুঃখ কষ্ট বেরিয়ে আসে বুকের গহীন থেকে।
বেশ চমৎকার ঠান্ডা বাতাস বয়ে তাদের উপর দিয়ে। দক্ষিণ দিকের কোন গাছে মনে হয় কাঁঠাল পেকেছে, তার ঘ্রাণ ভেসে আসছে বাতাসে। মাথার উপরের লিচু গাছ দুলে দুলে শব্দ করে তাদেরকে বাতাস করতে শুরু করে। দাদী আসমানের দিকে তাকায়। মেঘহীন আকাশে তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। দাদীর মনটা আরো উচাটন হয়ে ওঠে। কেমন যেন নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
বড় নাতনি রিনা কাছে এসে এবার দাদীর গলা জড়িয়ে ধরে। দাদীর জন্য তার অনেক মায়া হয়। দাদা মারা গেছে আজ বছর তিনেক হলো। কে জানে হয়তো দাদার কথা মনে পড়েছে দাদীর। রিনা দাদীর গালে গাল ঘষে জিজ্ঞেস করে, ও দাদী তোমার কি দাদার কথা মনে পড়ছে? এমুন চুপ মাইরা গেলা যে কথা কইতে কইতে? নাকি আমগ কথায় কষ্ট পাইছ?
দাদী আকাশের দিকেই তাকিয়ে থাকে। আকাশ থেকে একটা আলোর ছটা ছুটে আসতে দেখে দাদী। তাদের দিকেই ছুটে আসছে। বাড়ীর কাছাকাছি আসতেই শুন্যে মিলিয়ে যায় আলোটা। দাদীর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। রিনা তাকিয়েছিল দাদীর দৃষ্টি লক্ষ করে। সেও উল্কাটাকে আসতে এবং মিলিয়ে যেতে দেখে।
দাদী ধরা গলায় বলে, পরতেক দিন এই রকম কইরা একটা উল্কা আমার দিকে ছুইট্যা আসে, কিন্তু আমার কাছে আওনের আগেই নিভ্যা যায়। ক তো বইন, কেইল্যেগা এমুন অয়?
তোমার লগে দাদায় দুষ্টামি করে দাদী। অই আসমানে বইসা দাদায় তোমার লগে দুষ্টামি করে, তুমি বুঝ না?
রিনা’র কথা খুব ভালো লাগে তার। রিনা’কে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে দাদী।
তর দাদায় তর বাপেরে অনেক ভালবাসত। একে তো বড় পোলা, তার ওপরে হেই ছোটবেলা থাইকাই লজিং থাইকা পড়ালেখা করছে তর বাবায়। পরথমে ক্লাস থ্রি পাশ কইরা হেই সাওরাইদের হেমুরা সাবানতলা (সেগুনতলা) গিয়া লজিং উঠল একজনের বাড়ী। ভর্তি অইল ডেমরা মাদরাসায়। হেনতে ফাইভ পাশ কইরা গেলগা ঢাহায়। ভর্তি অইল মুসলিম স্কুলে, তহনতো আবার হেইডা আছিলো নিউ স্কীম মাদরাসা। ভর্তি তো অইল- থাকব কই? খাইবো কি? তগো দাদায় তো আর খরচ দিতে পারে না। তর বাপে করলো কি, স্কুলের এক স্যাররে সবকিছু ভাইঙ্গা কইলে তগ নানী বাড়ীর দহিনে বাগিচা আছে না, হেই বাগিচার পাড়ে এক বাড়িতে লজিং ঠিক কইরা দেয়। এক বছর না দুই বছর জানি হেই বাইত আছিলো তর বাপে। তারপর কেমনে কেমনে তর নানির বাড়ীতে লজিং আইল। আর হেনে থাইক্যাই মেট্রিক পাশ করলো, আইএ পাশ করলো, বিএ, এম.এ পাশ করলো। তর বাপে এমুন পাশই দিলো, মাইনষে ইছুবের নাম ধইরা আমগো চিনাইতে লাগলো।
দাদীর গল্পের শেষাংশটুকু রিনা’র জানা আছে। তার বাবা প্রফেসর ইউসুফ আলী পড়ালেখার জন্য যে কষ্ট করেছে এ রকম কষ্ট ক’জন করেছে তার জানা নাই। সেই ক্লাস থ্রী থেকেই লজিং থেকে থেকে তার পড়াশোনা! যা তারা কল্পনাও করতে পারে না। তাদের আট ভাই-বোনের সংসারে স্বচ্ছলতা নেই, কিন্তু শিক্ষকের অভাব নেই। বাড়ীতে লজিং স্যার আছে, বাবার মত উচ্চ শিক্ষিত অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আছে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া চাচা আছে, মামা আছে। শিক্ষার অভাব কোথায়! কিন্তু তারপরও তাদের রেজাল্ট অতো ভালো না। অথচ তাদের বাবা লজিং থেকে পড়াশোনা করে মেট্রিকে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছে। ইন্টারমিডিয়েটে ফাস্ট স্ট্যান্ড করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ পাশ করেছে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান দখল করে! ভাবতেই অবাক লাগে তার।
চাঁদের আলো আরো স্পষ্ট হয়ে গেছে। আজ চতুর্দশী, তারপরও মনে হচ্ছে আজ পূর্ণিমা। পুরো উঠোন জুড়ে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। নাতি-নাতনিরা সবাই জোছনার আলো গায়ে মেখে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ দাদীর কি মনে হলো, টানটান হয়ে জিজ্ঞেস করলো, অই তরা জোনাক পোকা দেখছছ?
কেউ কেউ বলল, হ দেখছি, কেউ কেউ বললো দেখি নাই।
দাদী বললেন, চল তগ জোনাক পোকা দেখামু, হাজারে হাজারে লাখে লাখে জোনাক পোকা। দেখবি কেমুন ধন্দ লাগে, চল। সবাই দাদীর কথায় উঠে পড়ে, দাদীও তসবিহ হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ায়।
অই, তরা সবাই সুরা ফাতেহা আর কুল হু আল্লা পইড়া বুকে ফু দিয়া ল। আমি লগে থাকলে কোন ডর নাই, চল।
দাদীর পিছু পিছু সবাই দল বেঁধে উত্তরের চালায় চলে যায়। বাড়ীর উত্তরের ঢাল গড়ানের পর টানা ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের ওপারে ঘন শাল-গজারির বন। দাদী থেমে সবাইকে বলে, দেখ ভালা কইরা চাইয়া ধানক্ষেত আর অই জঙ্গলের ভিত্‌রে। চোখ জুড়াইয়া দেইখ্যা ল।
সবাই দাদীর কথামত ধানক্ষেত আর গজারি বনের দিকে তাকায়। রিনা তো আনন্দে আহ্লাদিত হয়ে ওঠে, সুবনাহাল্লাহ, ও দাদী তুমি আমারে আগে কোনদিন দেহাও নাই কে দাদী।
সবাই ফিস ফিস করে যার যার মত আনন্দ ধ্বনি করতে থাকে। পাছে না আবার জোনাক পোকাগুলো চলে যায়! দাদীর কথাই সত্য, লাখ লাখ জোনাক পোকা কিলবিল করছে ধানক্ষেতের উপর। শূন্য ধানক্ষেতের মাটি ছুঁয়ে থাকা পানির উপর সেই জোনাক পোকার আলোর প্রতিবিম্ব পড়ে অদ্ভূত এক মায়াময় পরিবেশ তৈরী করছে। মনে হচ্ছে জোনাক পোকাগুলো শালবনের ভিতর থেকে বেরুচ্ছে আবার শালবনে ঢুকে যাচ্ছে। দাদী বললেন, তরা কি একটা জাদু দেখবি?
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, হ দাদী দেখমু।
দাদী মুচকি হেসে সবাইকে ইশারায় চুপ করতে বলে। সবাইকে ঘাসের উপর বসিয়ে দেয়। খুব নীচু স্বরে বলে, যা দেখবি তা কাউরে বলবি না ঠিক আছে! বললে আমার অনেক বড় ক্ষতি অইবো রে দাদুরা। ঠিক আছে?
সবাই সমস্বরে বললো, ঠিক আছে দাদী, ঠিক আছে।
আর শোন, অবাক হইলে মুখে রাও করবি না, মুখ চাইপ্যা ধইরা রাখবি, ঠিক আছে তো?
সবাই রাজী হয়ে যায় দাদীর কথায়, আর তৎক্ষনাৎ যার যার মুখ চেপে ধরে সবাই।
চারিদিকে একেবারে নিশ্চুপ। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দ, ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে দু’একটা রাতজাগা পাখি ডেকে উঠছে থেকে থেকে। নাতি-নাতনিদের সবার গা ছমছম করছে উত্তেজনায়। বাতাস বয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ।
দাদী তাদের চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে শূন্য ধানক্ষেতের দিকে ফিরে দাঁড়ায়। দু’হাত আসমানের দিকে তুলে কি যেন পড়ে মুখের কাছে নিয়ে এসেই কিছু একটা ছুঁড়ে দিচ্ছে ভঙ্গীমায় ধানক্ষেতের দিকে ছুঁড়ে দেয়। আর কি আশ্চর্য জোনাক পোকাগুলো সব একসাথে জড়ো হতে থাকে ধানক্ষেতের মাঝখানে। জড়ো হতে হতে একেবারে রিনা’র দাদার অবয়ব ডিসপ্লে করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ডিসপ্লেটি পরিপূর্ণ তার দাদা হয়ে যায়। দাদা হাসছে। দাদা হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানাচ্ছে। দাদা আবার হাসছে। তারপর ধীরে ধীরে ডিসপ্লেটি মিলিয়ে যায় আগের মতো। দাদী হাঁটু গেঁড়ে মাটিতে বসে পড়ে। দু’হাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে অঝোর ধারায় কেঁদে ওঠে।
এতক্ষণ নাতি-নাতনিরা সবাই ঘটনার আকস্মিতায় এতটাই বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলো যে, কারো মুখ দিয়ে কোন রা বের হয়নি। সবাই যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। এ তারা কি দেখলো আজ! কি দেখলো তারা! তারা কল্পনাই করতে পারে না এমন একটা দৃশ্যের। অসাধারণ দাদী, অসাধারণ!
বড় নাতনি রিনা’র সম্বিৎ ফিরে আসে। দৌড়ে যায় দাদীর কাছে। দাদীর মুখটি তুলে ধরে দুই হাতে। অশ্রুসিক্ত দাদীর মুখটি দুই হাতে মুছে দিয়ে বলে, ও দাদী তুমি কানতাছ? কান্দ ক্যা? কানবাই যদি তাইলে আমগ এগুলা দেহাইলা কে দাদী? ও দাদী, দাদীগো।
দাদী একটু ধাতস্ত হয়। রিনা’কে জড়িয়ে ধরে বলে, এই কান্দন কোন কিছু হারানের কান্দন না রে বইন। এই কান্দন গর্বের কান্দন। তর দাদায় আমারে এই জাদুডা হিগাইয়া দিয়া গেছিল, কোনদিন করি নাই। আজকা তগ সামনে করলাম। আর তগ দেহাইতে পাইরা আমার মনডা গর্বে ভইরা গেছে রে বইন। আমার স্বামী অনেক বড় কবিরাজ আছিল, আমার পোলা পরবেছারী কইরাই জীবন পার কইরা দিল। এর চাইতে আর বেশী কি চাইরে বইন, এর চাইতে বেশী আর কি চাই!!!
দাদী রোরুদ্যমান কান্না সামলাতে না পেরে রিনা’র কাঁধে মাথা রেখে আবারো কেঁদে ওঠে হু হু করে।

[ ঢাকা, পহেলা সেপ্টেম্বর, 2011 ]

No comments:

Post a Comment

Please place a comment!!!